০৬ নভেম্বর ২০২৪, বুধবার, ০৯:৩৮:১৮ পূর্বাহ্ন


ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন কী ও কেন করা হয়?
সোহেল জুলফিকার
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০২৪-০৯-১৬ ০০:১৮:১৬
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন কী ও কেন করা হয়? পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)


আগামীকাল সোমবার ১২ রবিউল আউয়াল, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। ৫৭০ সালের এই দিনে মানবজাতির জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরবের মক্কা নগরীর সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মা আমিনার কোল আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমন উপলক্ষে আল্লাহর শুকরিয়ার্থে শরীয়ত সম্মতভাবে খুশি উদযাপন করাই হলো ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:)। নবী রাসূল প্রেরণের ক্রমধারায় শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা:) এর আর্বিভাব ছিল একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। হযরত ঈসা (আঃ)-এর পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ ধরায় নবী রাসূলের আগমন ঘটেনি। এমতাবস্থায় বিশ্বের সর্বত্রই অত্যাচার-অনাচার, কুসংস্কার, নিষ্ঠুরতা ও সামাজিক দ্ব›দ্ব-সংঘাতের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এহেন চরমতম মানবিক অসাম্য ও মানবাধিকার বৈষম্যের ঘোর অন্ধকার যুগে আবির্ভূত হলেন সাইয়্যেদুল মোরছালিন খাতামুন্নাবীয়্যিন রাহমাতাল্লি আলামিন মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর থেকে পৃথিবীর সমস্ত জমিনই মসজিদে পরিণত হল। যার ফলে আমরা এখন মসজিদে ঘরে যানবাহনে পথে-ঘাটে সবখানেই নামাজ পড়তে পারছি। 

নবী করীম (সঃ) এর আগমনে আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হল আহলান ছাহলান, মারহাবান-মারহাবান! হযরত মা আমেনা বলেন তাঁর জন্মলগ্নের পর মুহূর্তেই একটা নূর প্রকাশিত হল যার আলোতে পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের সবকিছু আলোকিত হয় এবং যার আলোতে সিরিয়ার শাহী মহল মা আমেনা দেখতে পান। (বায়হাকী দালায়েলুন নবুওত মুসনাদে আহমদ) রাসূলে পাক (সঃ) দুনিয়াতে তশরিফ আনার সাথে সাথে ক্বাবা শরীফ মাকামে ইব্রাহীমের দিকে ঝুঁকে পড়ে রাসূলেপাক (সঃ) এর বেলাদাতের তাজিম করেছিল। (মাদারেজুন্নবুয়ত) ঈদ অর্থ আনন্দ-খুশী, উৎসব। আর মিলাদ শব্দের অর্থ জন্ম বা জন্মবৃত্তান্ত। কোন নেয়ামত ও রহমত লাভ করলেই আনন্দোৎসব করা যেরূপ মানুষের স্বভাবজাত কাজে তদ্রুপ আল্লাহ তায়ালার নির্দেশও তাই। যেমন কোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের পরওয়ার দিগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময় হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য। (হে রাসূল) বলুন-আল্লাহর অনুগ্রহে এবং তাঁর দয়া, সুতরাং তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। (সূরা ইউনুছ ৫৭/৫৮)। স্রষ্টার সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব নুরুন্নবী (সঃ)-এর শুভাগমন, যা কোরআন পাকে ঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন-“হে রাসূল (সঃ) আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহর নিয়ামত ও রহমত প্রাপ্তিতে আনন্দোৎসব কর। তোমাদের পুঞ্জিভূত সম্পদ অপেক্ষা এটি কত উত্তম!” (সূরা ইউনুছ-৫৮) মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এবং অমিয় বাণী নিয়ে যিনি এ ধরায় আগমন করে আমাাদের ধন্য করেছেন তার আনন্দোৎসব করা উম্মতে মোহাম্মদীসহ সকল ধর্ম-বর্ণের, জাতির জন্য অবশ্য কর্তব্য। যেমন আল্লাহ পাক বলেন-হে রাসূল (সঃ) ‘আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের জন্য একমাত্র রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া ঃ ১০৭) পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে এক উজ্জ্বল জ্যোতি (নূর) ও সুস্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে। (সূরা মায়েদা ঃ ১৫) সুতরাং এই নূর ও কিতাবকে আমাদের আঁকড়িয়ে ধরতে হবে এবং যথাযথ মর্যাদা সম্মান করতে হবে। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি নূরুন্নবী (সঃ)-এর মিলাদ শরীফের সম্মান করবে তার মৃত্যু ঈমানের সাথে এবং বিনা হিসাবে বেহেস্তে যাবে।” (আলনিয়া মাতুল-কোবরা আলাল আলাম)। 

নূরনবী (দঃ)-এর রওজা শরীফে ৭০ হাজার ফেরেস্তা আকাশ হতে জুলুছ (মিছিল) সহকারে দৈনিক ২ বার ফজরে ও আছরে আসে এবং সালাম পেশ করতে থাকে। কিয়ামত পর্যন্ত এ নিয়ম চলতে থাকবে। হযরত আদম (আঃ) হতে হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূলগণ ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ)-এর মজলিস পালন করতেন (মাদারেজুন্নবুয়ত)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফরমান-“নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তার ফিরিস্তাগণ নবী (সঃ)-এর উপর দরুদ পেশ করছেন।” “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ও তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পেশ কর আদবের সাথে। (সূরা আহযাব ঃ ৫৬)। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে রাসূল (সঃ) এর মর্যাদা কত বেশি এবং তার মিলাদুন্নবী পালন করা ও তার প্রতি দরুদও সালাম পেশ করা কত জরুরি। হযরত আল্লামা আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী (রঃ) তাঁর “মাসবাতা মিনাচ্ছুন্নাহ” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাইলাতুল কদর, ফজিলতের রাত্রি শবে বরাত, শবে মিরাজ, দুই ঈদের রাত এসবই রাহমাতাল্লিল আলামনিকে দান করা হয়েছে। যাকে দান করা হয়েছে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম স্বয়ং তার আগমন দিবস যে কত লাখ কোটি দিবস রজনীর চেয়ে উত্তম তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। যার উছিলায় সমগ্র পৃথিবীর, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারা, কীট-পতঙ্গ, আসমান-জমিন,পশু-পাখি, গাছপালাসহ মানবমন্ডলী সৃষ্টি করা হয়েছে। আদম (আঃ) সৃষ্টির পরে দেখলেন আরশে আজিমে খোদিত রয়েছে- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।” তখন তিনি আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন-হে পরওয়ার দেগার! আপনার নামের পাশে ওটা কার নাম শোভা পাচ্ছে। তখন আল্লাহপাক বললেন-ইনি হলেন আখেরী জমানার নবী আমার প্রিয় হাবীব হযরত মোহাম্মদ (সঃ)। যার উছিলায় তোমাকে ও সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছি। 

রাসূল পাক (সঃ) ফরমান- “আল্লাহপাক প্রথমেই আমার নূর (জ্যুতি) সৃষ্টি করেছেন।” পৃথিবী সৃষ্টির আগে নবী মোহাম্মদ (সঃ) কে আল্লাহর জাতি নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আদম (আঃ) কে আল্লাহ পাক তৈরি করার আগে আমাদের নবী মোহাম্মদ (সঃ) নবী ছিলেন। যেমন তিনি (সঃ) বলেন-আদম (আঃ) যখন মাটি আর পানিতে গড়াগড়ি করতো তখন ও আমি নবী ছিলাম। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-আল্লাহ পাক মুমিনগণের উপর বড়ই এহসান অনুগ্রহ করেছেন তাদের কাছে স্বীয় রাসূলকে পাঠিয়েছেন। (সূরা আল-ইমরান) সাধারণ নেয়ামত পাওয়ার জন্য যদি ঈদ বা খুশি করা যেতে পারে তবে সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ যিনি, তাঁর আগমনে খুশি করা যে কত উত্তম কাজ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রখ্যাত সাহারী হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত- একদা রাসুলুল্লাহ (সঃ) সহ হযরত আবু আমের (রাঃ)-এর ঘরে গমন করে দেখতে পেলেন যে, আবু আমের আনসারী (রাঃ) তাঁর নিজ সন্তানাদিসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করে রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর বেলাদাতের বিবরণী শোনাচ্ছেন। তাঁর একাজে আল্লাহর রাসূল অত্যান্ত আনন্দ অনুভব করলেন এবং বললেন-হে আমের! নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য তার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন এবং ফেরেস্তাকুল তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। যারা তোমার ন্যায় এরূপকর্ম করবে তারাও তোমার মত পরিত্রাণ পাবে। (হাকিকতে মোহাম্মদী) নূর নবী (সঃ)-এর জন্মের (বেলাদাতের) খবর শুনে খুশি পরম শক্র আবু লাহার তার দাসী সুয়াইবাকে মুক্ত করে দেয়, এবং এজন্য প্রতি ঈদে মিলাদুন্নবীর রাতে সে (আবু লাহাব) জাহান্নামে ও শান্তি পাচ্ছে। সাইয়েদুল মোরসালিন খাতামুন্নাবীয়িন নূরে মুজাচ্ছাম (সঃ)- এর মর্যাদা এত বেশি, যা আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। তাঁকে সকল নবী (আঃ) গণই মান্য করতেন এবং করেন। এমনকি পূর্ববর্তী সকল নবীগণ আল্লাহ পাকের কাছে আরজ জানিয়েছিলেন, তাদেরকে নবী না করে নবী মোহাম্মদ (সঃ)-এর উম্মত বানানোর জন্যে। সুবহানাল্লাহ! এমন নবীর উম্মত হয়েও আমরা তাকে জানিনা বুঝিনা বুঝতে চেষ্টা করি না, বরং তুচ্ছজ্ঞান করে ফেলে রাখি আমরা তার প্রতি দরূদ সালাম পাঠে কৃপণতা করি তাঁর শানে মিলাদ কিয়াম করতে লজ্জা বোধ করি হযরত আউলিয়া-কেরামগণ বলেন- সম্মানিত ব্যক্তিদের দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করাই আদব আর না করা বেয়াদবী। 

হযরত গাউছুল আজম (রাঃ) ১২ই রবিউল আউয়ালকে খুব গুরত্ব সহকারে পালন করতেন। একদিন স্বপ্নের মধ্যে নবী করিম (সঃ) তাকে বললেন যে, আমার বারই রবিউল আউয়ালের প্রতি তুমি যে সম্মান প্রদর্শন করে আসছ তারই বিনিময়ে আমি তোমাকে গেয়ারভী শরীফ দান করলাম। 

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, বৃদ্ধ নিবাস, মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে উন্নত খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।

আজ বাদ মাগরিব বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব গেইটে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন।

অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে- ওয়াজ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, সেমিনার, ইসলামি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, আরবি খুতবা লিখন প্রতিযোগিতা, ক্বিরাত মাহফিল, হামদ-না’ত, স্বরচিত কবিতা পাঠের মাহফিল, ইসলামি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী, ইসলামি বইমেলা, বিশেষ স্মরণিকা ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ। এ উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সকল বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, ৫৪টি ইসলামিক মিশন ও ৮ টি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।