প্রায় সকলেই জানেন, গত সাড়ে তিনবছর ধরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের হিমঘরে পড়ে আছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’। এই ছবিটি মুক্তির আলোয় ফেরানোর জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন নির্মাতা। সম্প্রতি তার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন দেশের শিল্প-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্টরাও। ছবিটি দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন আমজনতাও। কিন্তু এতসব আগ্রহ আর সমালোচনার পরেও বোর্ড বা মন্ত্রণালয় থেকে আসছে না কোনও স্পষ্ট ভাষ্য; কেন আটকে আছে আলোচিত ছবিটি।
মূলত এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবার কলম ধরলেন দেশের নন্দিত নির্মাতা-অভিনেতা আফজাল হোসেনও। তিনি বলেছেন, ‘ফারুকীর মন ভালো নেই। অভিনেতা দিলীপ কুমারেরও একদা মনখারাপ হয়েছিল।’ তার পুরো প্রতিক্রিয়াটি তুলে ধরা হলো পাঠকের দরবারে-
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অত্যন্ত প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা। বিরাট পৃথিবীর চলচ্চিত্র উঠোনে তার চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এমন অর্জনের জন্য বিশেষ যোগ্যতা থাকতে হয়। এই বিশেষ যোগ্যতা তরুণ প্রজন্মের অনেকের রয়েছে বলে বাংলাদেশের নাম বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সগৌরবে উচ্চারিত হয়।
মুখে মুখে দেশপ্রেম, দেশ নিয়ে গৌরবের কথা বলতে আমাদের বেশ ভালো লাগে। যাদের ভালো লাগে, তারা নিশ্চয় এটাও বুঝি- আমাদের দেশের মানুষ সংগ্রামী, সচেতন এবং সৃষ্টিশীল। এ ধারণা দুনিয়ার মানুষ যত বেশি জানতে পারবে- দেশ, দেশের মানুষ ততই সন্মানিত, বিশেষ হয়ে উঠবে। চলচ্চিত্র, সংগীত, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির শক্তিতেই দেশ ও দেশের মানুষ কতখানি সমৃদ্ধ তার প্রমাণ মেলে।
ফারুকীর চলচ্চিত্র ‘শনিবার বিকেল’ অনেকদিন ধরে আটকা পড়ে আছে। শিল্পের বেলায় আটক শব্দটা খুব বিচ্ছিরি ঠেকে। শিল্পী আঁকবার সময়, লিখতে বসে লেখক বা চিত্রনির্মাণের আগে যদি নির্মাতাকে আটকানো মানুষদের চেহারা ভেবে নিতে হয়- তা দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগের।
ফারুকীর মন ভালো নেই। অভিনেতা দিলীপ কুমারেরও একদা মনখারাপ হয়েছিল। সে শোনা গল্পটা বলি। দিলীপ কুমার ‘গঙ্গা যমুনা’ বানিয়েছিলেন ১৯৬১ সনে। এটিই তার প্রথম প্রযোজিত ছবি। নিজের লেখা কাহিনি, নীতিন বোসের সাথে যৌথভাবে পরিচালনাও করেছিলেন।
‘গঙ্গা যমুনা’ দুই ভাইয়ের গল্প। দুজনের একজন, গঙ্গা- ছিল ডাকাত। ডাকাত চরিত্রটির ভাষা শুনে তখনকার ভারতীয় সেন্সর বোর্ড বেঁকে বসে। তারা ভেবেছিলেন এ ছবি মুক্তি পেলে হিন্দি ভাষার মহা-সর্বনাশ হয়ে যাবে।
দিলীপ কুমার তখন মহা-তারকা। তাতে কি, বেচারা আটকে গেলেন সিনেমা প্রযোজনা করে। কয়েক মাস ধরে শত প্রকার চেষ্টা স্বত্বেও কোনও লাভ হচ্ছেনা বুঝে যোগাযোগ করেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রীর কন্যা। সে পরিচয় ছাড়াও নিজের আলাদা একটা অস্তিত্ব তখন গড়ে তুলেছেন। তার সাথে দেখা ও আলাপ আলোচনায় কাজ হয়।
মুক্তির পর থেকে আজ অবধি ভারতীয় চলচ্চিত্রের তালিকায় ‘গঙ্গা যমুনা’ বিশেষ হয়ে আছে। হিন্দি ভাষার কোনও ক্ষতি এ চলচ্চিত্রের দ্বারা ঘটেনি।
জগতে স্বপ্ন দেখার মানুষ আছে, আছে দুঃস্বপ্ন দেখা, দেখানোর মানুষও। যে মানুষ স্বপ্ন দেখে- দেখতে চায়, দেখা উপভোগ করে বলে দেখতে পায়। ভয়, দুশ্চিন্তায় কাটানো মানুষের দিন ও রাত দুঃস্বপ্নে কাটবারই কথা।
সৃষ্টিকর্তাকে খুব কৌতুকপ্রিয় মনে হয়। দুনিয়ার সকলের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখবার সাধ্য দিতে পারতেন। দেননি। দাবার ছকের মতো সাদা কালোকে মুখোমুখি রেখেছেন। তবে সান্ত্বনা ও আনন্দের কথা এই- কোনও সৃজনশীল মানুষ দ্বারা কখনোই মানুষের অনিষ্ট ঘটাননি। সৃজন দ্বারা চিরকালই মানুষের উপকার হয়েছে।