সাম্প্রতিক সময়ে টিপ অনেক চর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিপ পরছোস ক্যান-একজন শিক্ষকের প্রতি পুলিশ সদস্যের এমন তিরস্কারসূচক প্রশ্নের সূত্র ধরেই শুরু হয় টিপ-বিতর্ক। ফলে সমালোচনায় মুখর হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। সমালোচনা ও বিক্ষোভের মুখে ওই পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিবিসি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, হাজার বছর ধরে টিপ পরছেন নারীরা। এ অঞ্চলে টিপের প্রচলন অনেক দিনের।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হিন্দু সমাজে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ প্রথা যখন প্রবল ছিল। সে সময়ে হিন্দু সমাজে শ্রেণিভেদে ব্যবহৃত হতো টিপ। অন্যদিকে একজন ইতিহাসবিদ বলছেন, আগে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের নারীরাই টিপ ব্যবহার করতেন। আর একজন ইসলামি শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক বলছেন, টিপ যেহেতু সৌন্দর্যের ইস্যু, ফলে নারীরা ঘরে পরতে পারলেও বাইরে এটি পরতে পারবেন না।
বিবিসির উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- একসময় টিপের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ বা নারীদের শ্রেণি বা অবস্থান বোঝাতে এটি ব্যবহার হতো। ‘ইতিহাসের অলিগলি’ নামের গ্রন্থে জিয়াউল হক টিপ প্রসঙ্গে বিস্তারিত লিখেছেন। সেটি হুবহু রাখা হলো-
‘কপালে টিপ বাঙালি তথা আধুনিক বাঙালি নারীর প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। স্থান কাল আর পাত্র, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ নারীরা পুরুষের তুলনায় সৌন্দর্য চর্চা করেন বেশি।...বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে কপালে বড় একটি টিপ দেয়া, তার সৌন্দর্য চর্চার অন্যতম এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে এটা প্রায় প্রতিটি নারীর জন্যই একরকম বাধ্যতামূলক বিষয় যেন।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমাদের সমাজে এ প্রথাটা এলো কোথা হতে? এর উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়, বাল্মীকি যুগে।’
এর বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এই রীতি চালু হয়েছে প্রায় ৯৫০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে থেকে, যাকে বাল্মীকি যুগ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। সেই সময় তৎকালীন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ প্রবল ছিল। ব্রাহ্মণরা উচ্চ শ্রেণির, তারা ঈশ্বরের অতি নিকটজন, পূত-পবিত্র। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে তারা কপালে সাদা তিলক (চন্দন তিলক) দিতেন। এখনও দেন।’
‘ক্ষৈত্রিয় হলো যোদ্ধা শ্রেণি, তাদেরকে বীর হিসাবে গণ্য করা হতো। ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা ও সাহসের প্রতীক হিসাবে তারা কপালে লাল টিপ দিতো। আর সমাজে সবচেয়ে নিচু লোকজন হলো শূদ্ররা। ....তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। তারা কপালে কালো টিপ ব্যবহার করতে বাধ্য হতো। নারীদের মধ্যেও ভিন্ন মাত্রার শ্রেণিভেদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শ্রেণিভেদ অনুসারে তাদের বেলাতেও এই টিপ ব্যবহারে একটু ভিন্নতা ছিল।’ এমনটাই লেখেন জিয়াউল হক।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘সেই সময় যেসব নারীদের মন্দিরে উৎসর্গ করা হতো, তাদের চিহ্নিত করার জন্যও টিপ দেয়ার রীতি চালু হয়েছিল। আবার উচ্চ বর্ণের বিবাহিত নারীরাও বিয়ের চিহ্নস্বরূপ কপালেসিঁদুরের টিপ পরতেন।’
ইসলামে টিপ পরা
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুখতার আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, ‘টিপ নিয়ে যে বিতর্কটি আমরা দেখছি, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। সরিয়া দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে গেলে, একজন মুসলমান নারী টিপ পরতে পারবেন কি পারবেন না, এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা কোরান বা হাদিসে নেই।’
‘একজন নারী তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের অলংকার পরতে পারবেন। টিপও তার অলংকরণ বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য একটি উপকরণ হিসাবে তিনি ব্যবহার করতে পারবেন। টিপ পরা নিষিদ্ধ, এরকম কোন বক্তব্য কোরান বা হাদিসে নেই।’ যোগ করেন এই অধ্যাপক।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে বলেন, ‘টিপের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আবহমান কাল থেকে বাঙালিদের মধ্যে ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষ বাঙালিরা টিপ ব্যবহার করতো। সৌন্দর্য চর্চার ইতিহাসের সঙ্গে টিপের বিবর্তন যুক্ত, বাঙালির জন্য অন্তত ধর্ম-বর্ণের কোন সম্পর্ক নেই।’
তবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন ইসলামিক শিক্ষার অধ্যাপক মুখতার আহমেদ।
তিনি বলছেন, ‘তবে ইসলামের সরিয়া বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, একজন মুসলিম নারী নিজস্ব অঙ্গনে, ঘরের মধ্যে, মাহরাম পুরুষদের (যে পুরুষদের সামনে দেখা দেয়া বাধা নেই) তাদের সামনে বা নারীদের সামনে টিপ পরতে পারবেন। কিন্তু এটা যেহেতু একটা সৌন্দর্যের ইস্যু, তিনি অন্য কোনও পুরুষের সামনে ডিসপ্লে করতে পারবেন না।’
ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখতে গেলে টিপকে এই অঞ্চলে হিন্দু বিবাহিত ধর্মাবলম্বীদের একটি অলংকরণ হিসাবে অনেকে দেখে থাকেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। ফলে, তিনি মনে করেন, টিপ পুরোপুরি বাঙালি কালচারের অংশ তা নিয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে।
ইতিহাসবিদের চোখে টিপ
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে।
তার ভাষ্যে, ‘এটা শুধুমাত্র বাঙালি জাতির বা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনও ব্যাপার ছিল না। আঠারো শতকে তো টিপের ব্যবহার খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তখনকার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার নারীরা টিপ ব্যবহার করতেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেই সময় সব ধর্মের নারীদের মধ্যেই টিপ পরার প্রচলন ছিল। তখনকার মুসলমানদের মধ্যেও টিপ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তার মতে, ইসলামেও টিপ পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি।’