কাতার বিশ্বকাপে লিওনেল
মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্স আর্জেন্টিনার মানুষের অনেক ভালোবাসা পাচ্ছেন। কিন্তু
দেশটির মানুষের আগের ভালোবাসার মানুষ দিয়েগো ম্যারাডোনা আবার সামনে চলে আসতে পারেন।
যদি শেষ চেষ্টায় মেসি দেশকে বিশ্বকাপের ট্রফি উপহার দিতে না পারেন।
খাটো ও দুর্দান্ত ১০ নম্বর
জার্সিধারী এই দুই ফুটবলার বিশ্বকে রাঙিয়েছেন তাদের অসামান্য গোল করার দক্ষতা দিয়ে।
খেলার ধরনে আশ্চর্যজনক মিল, বল পায়ে রেখে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ ভেদ করে আলতো পায়ে গোল
করার দক্ষতায় উভয়েই পারদর্শী।
তবুও দুই বছর আগে মৃত্যুবরণ
করা ম্যারাডোনাই কেবল বৃহত্তম ট্রফি বিশ্বকাপ জিতেছেন। ১৯৮৬ সালে মাঝারি মানের একটি
দলকে নিয়ে বিশ্বকাপ জেতেন তিনি। ফকল্যান্ড যুদ্ধে হারের লজ্জার পর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে
তার ‘ঈশ্বরের হাত’ গোলটি আর্জেন্টিনার
জাতীয় বিদ্রোহের প্রতীকে পরিণত হয়।
বেশ কয়েক বছর ধরে আর্জেন্টিনার
সমর্থকরা বলে আসছিলেন, মেসি যত বার ব্যালন ডি’ওর এবং বার্সেলোনার
হয়ে ট্রফি জিতুন না কেন বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার আগে তিনি ম্যারাডোনার সমকক্ষ হতে পারবেন
না।
তাদের আরও প্রশ্ন ছিল।
কেন মেসি এত লাজুক এবং অন্তর্মূখী? যখন তাদের ভালোবাসার দুষ্টু ছেলে ম্যারাডোনা কৌতুক
বলে, গান গেয়ে, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মন্তব্য করে তাদের বিনোদন ও আনন্দ দিয়েছেন।
কেউ কেউ বিড়বিড় করতেন, বিশেষ করে বয়স্ক ভক্তরা, মেসি কি আদৌ প্রকৃত আর্জেন্টাইন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে আর্জেন্টিনা ছেড়ে স্পেন পাড়ি দেন মেসি। কিন্তু ম্যারাডোনাকে অনেক বেশি দেশের ছেলে মনে হয় তাদের কাছে। একটি বস্তিতে জন্ম, বোকা জুনিয়র্সসহ স্থানীয় ক্লাবে খেলে বড় হয়েছেন তিনি।
‘ভালোবাসা-ঘৃণা’
ম্যারাডোনার চেয়ে বেশি
গোল ও সম্মান অর্জন করেছেন মেসি, এতে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকি জাতীয় দলের হয়ে বেশিবার
মাঠে নেমেছেন তিনি। মাত্র গত সপ্তাহে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে
গেছেন মেসি। তিনি নিজেকে এখনও দারুন ফিট রেখেছেন। যেখানে ম্যারাডোনার মাদক সেবন ও উচ্ছৃঙ্খল
জীবনযাপন তার অনেক একনিষ্ঠ ভক্তকেও ব্যথিত ও হতাশ করেছে।
মেসির ঘনিষ্ঠরা বলছেন,
অতীতের তার লাজুকতা হয়ত ছদ্মবেশ হতে পারে। কিন্তু তিনি সব সময় আর্জেন্টিনার জন্য গৌরব
বয়ে আনতে মুখিয়ে ছিলেন। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনাকে নেতৃত্ব দিয়ে জেতানোর
পর কান্নায় ভেঙে পড়ায় তা প্রমাণিত হয়েছে। এটি ছিল গত ২৮ বছরের মধ্যে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ ট্রফি জয়।
বুয়েনস এইরেসের বাসিন্দা
৪৪ বছর বয়সী ভক্ত গুস্তাভো ফ্রাঞ্চিনি বলেন, মেসির সঙ্গে আর্জেন্টাইনদের সব সময় ভালোবাসা-ঘৃণার
সম্পর্ক ছিল। আমরা সব সময় তাকে ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনা করেছি। ৩৬ বছর আগে আমরা শেষ
বিশ্বকাপ জিতেছি। এরপর আমরা জিততে পারিনি। সবাই বলছে ম্যারাডোনার পর্যায়ে যেতে তাকে
বিশ্বকাপ জিততে হবে। তবে আমার মতো অনেকেই মনে করে, ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনা একাই যেভাবে
দুর্বল দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন সেই তুলনায় ম্যারাডোনার কাছাকাছি যাওয়ার মতো নন মেসি।
কাতারের এবারের বিশ্বকাপ
মেসির পঞ্চম ও শেষ সুযোগ। তিনিই এখন দলের প্রাণ ভোমরা। ১৮ ডিসেম্বর বিশ্বকাপ ট্রফি
উঁচিয়ে ধরার মতো ভালো সুযোগও রয়েছে আর্জেন্টিনার।
কাতারের স্টেডিয়াম, দেশের বার ও পার্কে ভক্তরা এখন পর্যন্ত মেসিকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। তার দুটি গোলে উদযাপনে মেতেছেন তারা। গ্রুপ পর্বের শেষ খেলায় পেনাল্টি মিসের পরও তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তার ছবিযুক্ত পতাকা ও ব্যানার নিয়ে গর্বের সঙ্গে প্যারেডে শামিল হচ্ছেন তারা।
আবেগী মেসি
এসব ব্যানারের অনেকগুলোতে
মেসি ও ম্যারাডোনাকে এক সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ এমনভাবে ম্যারাডোনার ছবি যুক্ত
করেছেন যাতে দেখা যাচ্ছে প্রয়াত ১০ নম্বর জার্সিধারী বেহেশত থেকে নিজের উত্তরসূরীর
দিকে চেয়ে হাসছেন। মেসি নিজেও আবেগের বাঁধ ভেঙে দিয়েছেন সৌদি আরবের কাছে হতাশার পরাজয়ের
পর। মেক্সিকো ও পোল্যান্ডের সঙ্গে জয়ের পর বন্য উল্লাসে দলের সঙ্গে মেতেছেন, ড্রেসিং
রুমে গান গেয়েছেন।
আর্জেন্টাইন রাজধানীর ৩৯
বছর বয়সী আরেক ভক্ত ফাসুন্দো মোরেনো বলেন, কোপা আমেরিকা জয়ের পর তার কাঁধের বোঝা কমেছে
বলে মনে হচ্ছে। এখন তিনি অনেক বেশি নির্ভার এবং উপভোগ করছেন।
তিনি বলেন, আমার কাছে মেসি
সব সময় জাতীয় দলের প্রতি দায়িত্ব অনুভব ও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। তিনি আমার আদর্শ।
ম্যারাডোনা ও তার ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু মাঠে তারা দুজন একই কাজ করেন।
মেসিকে নিয়ে লেখা একটি
বইয়ের লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক মার্সেলো সোট্টিল বলছেন, মেসির পরিচ্ছন্ন ভাবর্মূতি এবং
নম্রতাপূর্ণ চরিত্র আর্জেন্টাইনদের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন। আর আর্জেন্টাইনদের
প্রকৃত চরিত্রের অনেকটাই ফুটে ওঠে বিদ্রোহী ম্যারাডোনার চরিত্রে।
তিনি বলেন, ম্যারাডোনা
ও মেসিকে বেশি পছন্দ করা মানুষের প্রজন্মের মধ্যে একটি ব্যবধান রয়েছে। বয়স্কদের কাছে
ম্যারাডোনা এখনও বেশি পছন্দের এবং তরুণ ভক্তদের ঝোঁক মেসির প্রতি বেশি।
মার্সেলো সোট্টিল বলেন,
“আমার ১৮ বছর বয়সী ছেলে কখনও মেসিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
সে কখনও বলেনি ‘মেসি বার্সেলোনার হয়ে ভালো খেলে, আর্জেন্টিনার হয়ে
নয়’। বার্সেলোনায় সফল ও সম্মানী হওয়ায় খ্যাতির বিড়ম্বনায়
পড়েছেন মেসি। কিন্তু একই সঙ্গে আর্জেন্টিনায় প্রায়ই সমালোচকদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।”
সূত্র: রয়টার্স