২০১৮ সালের ২২ মে মারা যান অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ। জানা যায়, তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অভিনয় শিল্পী সংঘ কিছু তথ্য জানতে পারে যা প্রমাণ করে ঘটনাটি সাদামাটা ছিল না। কারণ সেইদিন তাজিন আহমেদকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে রেখে কেউ একজন পালিয়ে যায়। জানা যায়, তাজিনের সঙ্গে সেদিন তাঁর সঙ্গে রূপসজ্জাকারী মিহির ছিলেন। এই মিহিরের নাম এবারও একই ভাবে আলোচনায় আসলো। তিনি অভিনেত্রী হোমায়রা হিমু মৃত্যুর সময় তাঁর বাসায় ছিলেন। অভিনয় শিল্পী সংঘের একটি সূত্র জানায়, এই মিহির কেন বারবার কাজ থেকে দূরে থাকা অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন? যার উত্তর মিলছে না।
অভিনয় শিল্পী সংঘের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই রূপসজ্জাকারী মিহির দীর্ঘসময় ধরে মিডিয়ায় কাজ করেন। তাঁর বাড়ি সিলেট অঞ্চলে। ব্যক্তিগত কিছু কারণে তাঁকে এড়িয়ে চলতেন শিল্পী–কলাকুশলীরা। পরবর্তী সময়ে কাজ কমে যাওয়া সে হতাশ হয়ে পড়ে। কাজ কম থাকলেও শুটিংয়ে তার যাতায়াত থাকতো এবং সেই সময় বিভিন্ন অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ান এই রূপসজ্জাকারী। এভাবেই তাঁর সঙ্গে করোনার আগে অভিনেত্রী হোমায়রা হিমুর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান বলেন, ‘মিহির অনেক আগে নিয়মিত কাজ করত। কিছু সমস্যার কারণে তাকে কাজে তেমন ডাকা হতো না। কোনো অভিনয়শিল্পী প্রস্তাব করলে হয়তো তার ডাক পড়ত। মিহিরের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, অল্প সময়ে সে সবার সঙ্গে মিশতে পারত। পরবর্তী সময়ে পরিবারের সদস্যদের মতো হয়ে যেত। একবার ভালো সম্পর্ক হলেই যেকোনো প্রয়োজনে যে কেউ সহজেই তাকে পেত। এই কারণে একসময় সে সম্পর্ক গড়ে তোলা অভিনয়শিল্পীদের বাসাতেই থাকা শুরু করে। ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পাশে থাকত। এমনটাই জানতে পেরেছি।’
তাজিন আহমেদ একই জীবন যাপন করতেন। বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন, মা থেকে দূরে ছিলেন তিনি। এই অভিনেত্রী সেই সময় কাছের কয়েকজনকে ঋণ নিতে সহযোগিতা করেন। পরে সেসব মানুষের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক হলে তিনি নিজেই ঝামেলায় জড়িয়ে যান। কাজ থেকেও তিনি দূরে ছিলেন। একাকী এই সময়ে মিহিরের সঙ্গে তাজিনের বন্ধুত্ব হয়। অর্থনৈতিক লেনদেন থেকেই এই সম্পর্ক। পরিবারের একজনের মতো ছিলেন এই মিহির। সম্প্রতি হোমায়রা হিমু মারা যাওয়ার পর আবার মিহিরের নাম এলে বেশ কয়েকজন অভিনয়শিল্পী চিন্তিত হন। অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবীব নাসিম বলেন, ‘হোমায়রা হিমু কিছুদিন কাজ করেননি। কিছুটা বিরতির পর সম্প্রতি সে দু–তিনটা ধারাবাহিকে নাম লিখিয়েছিল। এই বছরের শুরুর দিকে আমাদের শিল্পীদের বড় আয়োজন ছিল। সেখানে তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে অনেকেরই যোগাযোগ ছিল। এমন না যে তার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল বা কাজ পাচ্ছিল না। অনেকেই বলছেন, কেউ মারা গেলেই তাকে সবাই স্মরণ করেন, বিষয়টা এমন না। কেউ দূরে থাকলে অন্যদের কী করার আছে?’
হোমায়রা হিমুর বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তাঁর মা–বাবা কেউ বেঁচে নেই। এসব নিয়ে মাঝে মধ্যে তাঁর মধ্যে একাকিত্ব পেয়ে বসত বলে জানান তাঁর সহকর্মীরা। এ জন্য অনেকটা নিজের মতো করেই চলতে পছন্দ করতেন। অনলাইনে তাঁর সক্রিয় থাকা কথা জানা গেছে।
কেউ না থাকায় মৃত্যুর পরে তাঁর সব দায়িত্ব পালন করেছেন অভিনয় শিল্পী সংঘ। তখন তারা স্বাভাবিক মৃত্যু মনে করেই পাশে ছিল। কিন্তু এবার মনে সন্দেহ জাগায়। নাসিম আরও বলেন, ‘এর আগেও একইভাবে তাজিনকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে একজন পালিয়ে যায়। এবারও হিমুকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে একজন পালিয়ে যায়। পরে জানা যায়, তার বাসায় সেই মিহিরই ছিল। এই নিয়ে ঘটনা কী, কীভাবে মৃত্যু হয়েছে, সেটা পোস্টমর্টেম হওয়ার পরেই জানা যাবে। কেউ দায়ী থাকলে আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলব। কিন্তু এখন আমরা কোনো কিছু বলতে পারছি না।’
অভিনেত্রী হোমায়রা হিমুর আত্মহত্যা করার কথা শুনে হতবাক সহকর্মীরা। ঘটনাটি তাঁরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না। অভিনেত্রী দীপা খন্দকার বলেন, ‘তাজিনের বাসায় ছিল মিহির। সে মারা যাওয়ার পরে হোমায়রা হিমুর বাসাতেও সে থাকত। দুজনের মৃত্যু হলো। এটা অবশ্যই মনে একটা প্রশ্ন তৈরি করে। অনেকেই বলছে, হিমুর জীবন যাপন একটু অন্য রকমের ছিল। আমাদের যুক্তি হচ্ছে, একটা মানুষ শৃঙ্খলার বাইরে জীবন যাপন যদি করেও এর মানে এই না যে কারও তাকে মেরে ফেলার অধিকার আছে। মিহির এবং ওর সঙ্গে আরেকজন যে ছিল, শুনেছি সে তার বয়ফ্রেন্ড। এখন যেই হোক না কেন, আমার ভাষ্য, একটা বাসায় দুটো মানুষ ছিল। তাদের উপস্থিতিতে একটা মানুষ আত্মহত্যা করে বসল। দরজা খোলা ছিল, একটা মানুষ বলছেও সুইসাইড করে ফেলবে, অথচ তারা কিছুই দেখতে পেল না। মেয়েটা মরেই গেল। এটা আমার কাছে রিয়েলিস্টিক মনে হচ্ছে না।’
ঘটনার দিন হিমুকে হাসপাতালে রেখে হিমুর ফোন নিয়ে পালিয়ে যান জিয়াউদ্দিন নামক এক বেক্তি। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঢাকার বংশাল থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিয়াউদ্দিনের বিষয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে উঠে আসে, হিমুর সঙ্গে জিয়াউদ্দিনের ৯ বছর ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন। তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত ঝগড়া হতো। পরে আত্মহত্যা করেন হিমু।
অভিনেতা রওনক হাসান বলেন, ‘এই আত্মহত্যার ঘটনাটা আমাদের কাছে একটু ধোঁয়াশা তৈরি করছে। এ ছাড়া হিমুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এখন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছাড়া কিছুই বলা যাবে না।’ সব শেষে দীপা খন্দকার জানান, মিহিরকে তিনি অনেক দিন থেকেই চেনেন। বিভিন্ন সময় তাঁর কাছ থেকে সহযোগিতাও নিয়েছেন।
দীপা বলেন, ‘মিহিরকে আমি মেকআপশিল্পী হিসেবেই বেশি পেয়েছি। পারসোনালি খুব একটা মিশিনি। পরিচয় থাকার কারণে সে অনেক সময়ই ফোন করে বলেছে, ভালো নেই, খেতে পায় না। শুনেছি, এটা–ওটার অভ্যাস আছে। বিভিন্ন সময় টাকা ধার চেয়েছে। অনেকেই তো অনেক সময় হেল্প করি, সেভাবেই মিহিরকেও হেল্প করেছি। কিন্তু তাজিন ও হিমুর বাসায় মৃত্যুর আগে থাকাটা সন্দেহজনক, স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বলতে তো পারব না কে দোষী।’ জানা যায়, মিহির তাজিনের আগে অভিনেত্রী শ্রাবন্তীর মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন।